মানুষে মানুষেই তাে কথা হয়, তাই না? যদি পশুর সাথে কথা বলেনও নিশ্চয়ই আশা করেন না সে আপনার কথা বুঝবে? না, তা সম্ভবও নয৷ কিন্তু মানুষের সাথে কথা বলার ব্যাপারটা কি? মানুষ আপনার কথা বােঝে৷ বেশ ভালাে কথা৷ কিন্তু সে কি আপনার সব কথা মেনে নেয়? না, নেয় না৷
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষ আপনার সাথে একমত হচ্ছে না৷ আপনি যা বলছেন সে তা মেনে নিচ্ছে না৷ এরকম হলে করণীয় কি? করণীয় কি তা ঠিক করার আগে আপনাকে ঠিক করতে হবে কি করণীয় নয়৷ তর্ক করা বােকামি, সুতরাং সেটা করণীয় নয়৷ আপনার মতের সঙ্গে মিলছে, একথা আপনি বললেই তর্ক বেঁধে যাবার ভয় আছে৷
আরো পড়ুনঃ- লক্ষ্য নির্ধারন করে কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাবেন
সুতরাং মতের সাথে মিলছে না এটা আপনি প্রথমে আলােচককে জানতে দিবেন না, চেপে যাবেন৷ যেসব বিষয়ে মিল আছে, শুধু সেগুলাে উল্লেখ করতে থাকুন বারবার৷ সম্ভব হলে বলুন, আমাদের দুজনেরই কাম্য বস্তু এক, কিন্তু তা পাবার উপায় সম্পর্কে হয়ত মতভেদ আছে৷ ‘হা ' - এই শব্দটির মধ্যে যাদু আছে, তা কি আপনি জানেন?
আপনার কথা শুনে কেউ যখন ‘হ্যা' শব্দটি উচ্চারণ করে, সেটা আপনার বিজয়েরই সামিল৷ কাউকে যদি স্বমতে আনতে চান, তাকে দিয়ে “ হা বলিয়ে নেওয়া যায়৷ সে যদি আপনার প্রধান শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়, তাকে দিয়েও হ্যা ' উচ্চারণ করিয়ে নেয়া আসলে মােটেই কঠিন কোন ব্যাপার নয়৷
আপনার মতের সাথে মিল নেই, আপনার শর্তে রাজি নয় এরকম লােককে কিভাবে স্বমতে আনার জন্য ‘হ্যা' বলিয়ে নিতে হয় সে প্রসঙ্গে পরে আসছি৷ একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ একজন মনস্তাত্ত্বিক কি বলেছেন জানেন? তিনি বলেছেনঃ কেউ যদি একবার ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করে, তাকে দিয়ে হ্যা ' বলানাে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷
'না' আসলে প্রতিবাদ, মতানৈক্য, ব্যালেঞ্জ, অসন্তোষ, বিরক্তি ইত্যাদি প্রতিকূল মনােভাবের প্রকাশ ঘটায়৷ কাউকে এমন কিছু বলবেন না, যার ফলে নেতিবাচক মনােভাব তার মধ্যে জেগে ওঠে৷ স্বমতে আনতে হলে তার মধ্যে ইতিবাচক মনােভাব জাগাতেই হবে৷ প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা, রুচি ও মনমানসিকতা রয়েছে - এগুলােকে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে রক্ষা করার জন্য, সহজে বদলাতে চায় না৷
আপনার কথার উত্তরে সে 'হ্যা' বলবে না এটাই তাে স্বাভাবিক৷ কেননা কে চায় তার নিজস্ব পছন্দ, রুচি, ইচ্ছা বা মতামত জলাঞ্জলি দিতে? আপনি চান? চান না৷ সুতরাং আপনার মতােই আর সবাই চায় না৷ কিন্তু কেউ চান বা না চান, মানুষ আমরা সবাই আমদের নিজস্ব মতামত পরিবর্তন করছি ঠিকই কিন্তু তার মানে কি এই যে আগের মতামতগুলােকে অযৌক্তিক বা বাজে বলে বাতিল ঘােষণা করার মাধ্যমে নতুন মতামত করছি?
আরো পড়ুনঃ- ব্যার্থতার ৩০ টি কারণ
না, তা নয়৷ আমরা আমাদের পূর্বতন মতামতগুলােকে অন্তত আংশিক, ক্ষেত্রেবিশেষ পুরােপুরি টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে নতুন মতামত পােষণ করছি৷ আমি গিয়েছিলাম হাতি মার্কা ছাতা কিনতে৷ হাতি মার্কা ছাতাই বাজারের সেরা, এ আমি খবরের কাগজ, রেডিও আর টিভির বিজ্ঞাপনের বদৌলতেই জানি, সুতরাং হাতি মার্কা ছাড়া অন্য ছাতা আমি কিনব না৷ বিক্রেতা আমাকে জানাল, হাতি মার্কা ছাতা ভালাে নয়, তার চেয়ে ভালাে ছাতা সে আমাকে দেখাতে পারে৷
বিক্রেতাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি বলতে চাইছেন হাতি মার্কা ছাতা সেরা ছাতা নয়? বিক্রেতা উত্তরে বলল, ' না. ঘােড়া মার্কা ছাতার কাছে হাতি মার্কা ছাতা কিছুই নয়৷ ঐ দোকানে থেকে ছাতা আমি কিনলাম না৷ কারণ? ছাতা সম্পর্কে আমার যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাসটাকে বিক্রেতা মর্যাদা দেয়নি, আমার বিশ্বাসটাকে সে সমর্থন করেনি৷
কিন্তু ছাতা আমাকে কিনতেই হবে৷ গেলাম অন্য এক দোকানে৷ এইবার আমি সরাসরি হাতি মার্কা ছাতা দেখতে না চেয়ে জানতে চাইলাম “আচ্ছা, বলুন তাে - কি মার্কা ছাতা কেনা উচিত আমার? হাতি মার্কা ছাতা কি বাজারের সেরা ছাতা নয়? বিক্রেতা চট করে আমার দুর্বলতা ধরে ফেলল, বিজ্ঞের মতাে মাথা নেড়ে সে বললঃ ‘হাতি মার্কা ছাতা সেরা কিনা, এর গুণ বিচার করে আপনিই সিদ্ধান্ত নিন৷
হাতি মার্কা ছাতার সবচেয়ে বড় গুণ, একটা বড় কোম্পানীর তৈরি জিনিস৷ কোম্পানীটার প্রচুর সুনাম রয়েছে৷ শুধু যে ছাতা তৈরি করে তা নয়, এই কোম্পানী জাল, মশারি, মােজা, গেঞ্জি, তাবু ইত্যাদি আরাে অনেক রকম জিনিস তৈরি করে এবং যা তৈরি করে কোনটাই মানের দিক থেকে খারাপ নয়৷ মনে মনে আমি খুশি হয়ে ওঠি৷
আরো পড়ুনঃ- যেকোন বাজে অভ্যাস পাল্টানোর উপায়
জিনিস কিনতে হলে বিখ্যাত কোম্পানীর জিনিস কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ বিক্রেতা তখনও বলে চলেছে - ‘ কোম্পানীর হাতি মার্কা ছাতা নতুন একটা জিনিস, বাজার একেবারে মাৎ করে দিয়েছে৷ মানুষ কিনছেও৷ ছাতা বলতে সবাই এখন হাতি মার্কা ছাতাকেই চেনে৷ দাম আর সব ছাতার চেয়ে বেশি, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ হাতি মার্কা ছাতার ডিজাইনের ছাতা যদি কিনতে চান, হাতি মার্কা ছাড়াই আপনার কেনা উচিত৷
হাতলটা যদি ভেঙ্গে যায় চিন্তা নেই, খুচরা দামে কিনতে পাবেন আপনি, ভাঙ্গাটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা লাগিয়ে নিলেই চলবে৷ ছাতার সাথে, আবার আশ্চর্য সুন্দর একটা খাপ আছে, ছাতা বন্ধ করে ওই খাপে ঢুকিয়ে দেয়ালে বা র্যাকে ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন৷ সবচেয়ে লােভনীয় ব্যাপার, একটি ছাতা কেনার সময় আপনি ক্যাশমেমাের সাথে পাবেন একটি লাকী কুপন৷
প্রতি মাসে ছ'বার লটারীর মাধ্যমে ক্রেতাদেরকে পুরস্কৃত করা ব্যবস্থা করেছে কোম্পানী৷ মােট একশাে একটি পুরস্কার৷ প্রথম পুরস্কার দু লাখ টাকা৷ দ্বিতীয় পুরস্কার এক লাখ টাকা, তৃতীয় পুরস্কার পঞ্চাশ হাজার টাকা৷ এমন হু হু করে হাতি বিক্রি হবার এটাও একটা কারণ৷ বিক্রেতা একবারও হাতি মার্ক ছাতার বিরুদ্ধে একটা কথ্যও উচ্চারণ করেনি৷
হাতি মার্কা ছাতা আমার কেনা উচিত নয়, একথা সে মুখেও আনেনি৷ তবুও আমি হাতি মার্কা ছাতা কিনিনি৷ কিনেছিলাম ঘােড়া মার্কা ছাতা৷ অথচ ঘােড়া মার্কা ছাতা সে আমাকে কিনতে সাধেনি একবারও৷ হাতি মার্কা ছাতা সম্পর্কে আমার যে বিশ্বাস ছিল সেই বিশ্বাসের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা প্রয়াস পায়নি বুদ্ধিমান সেলসম্যান, কিন্তু পরিষ্কারভাবে সে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে হাতি - মার্কা ছাতা টেকসই হবে না৷
আরো পড়ুনঃ- কিভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যায়
বিক্রেতা আমার পছন্দের বিরােধিতা না করে সে শুধু ওই ছাতার বিশেষ গুণগুলাে ব্যাখ্যা করেছিল আমার কাছে৷ কিন্তু সৌখিন ছাতা আমার দরকার ছিল না, আমার দরকার ছিল টেকসই একটি ছাতা৷ তাই, ঘােড়া মার্কা ছাতা হাতি মার্কা ছাতায় চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং মজবুত হবে বুঝতে পেরে ওটাই আমি কিনি৷ তবে হাতি মার্কা ছাতার ডিজাইন যে সত্যি আধুনিক এবং ইহা যে সৌখিনতার প্রতীক তাতেও আমার কোন সন্দেহ ছিল না৷
অর্থাৎ আমার পূর্বের বিশ্বাস বা ধারণাটা অপরিবর্তিতই রইল৷ ছাতা সম্পর্কে আমার নতুন ধারণা হলেও পুরানাে ধারণাটা কিন্তু বাতিল হয়ে গেল না৷ আমার ধারণাটাকে প্রথম বিক্রেতা পুরােপুরি বাতিল করে দিতে চেয়েছিল বলে আমি তার কাছ থেকে ঘােড়া মার্কা ছাতা কিনতে চাইনি৷ এই - ই হয়৷ আমরা চাই, যাই বলি না কেন, মানুষ তা মেনে নিক, সমর্থন করুক, তারপর তার যদি আলাদা কিছু বলার থাকে বলুক৷
আমাদের মতামতকে আগ্রহ করে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতামতকে কেউ যদি প্রাধান্য দিতে চায়, আমরা তা মেনে নেই না৷ সুতরাং কাউকে স্বমতে আনতে হলে তাকে দিয়ে প্রথমে যত বেশিবার সম্ভব হ্যা 'শব্দটি উচ্চারণ করিয়ে নিন৷ 'হ্যা' বলবার জন্য না হয় আপনি প্রথমে প্রসঙ্গ বহির্ভূত বিষয়ে কথা বলুন৷ মেঘলা আকাশ দেখে বলুন, বৃষ্টি আসতে পারে৷ আপনার প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই বলবে, “ হ্যা৷
প্রতিপক্ষ যদি নতুন শার্ট গায়ে দিয়ে থাকে, তাকে বলুন, খুব মানিয়েছে কিন্তু আপনাকে, শার্টটা নতুন তৈরি করিয়েছেন বুঝি? তিনি হ্যা 'বলবেন৷ এরকমভাবে যতােবার বেশি সম্ভব হ্যা তাকে দিয়ে বলিয়ে নিন৷ ‘ হ্যা বলিয়ে নেওয়া কত সহজ, কিন্তু আশ্চর্য এই ফলপ্রসূ কৌশলটা অমর মহামনীষী সক্রেটিসের একটা আবিষ্কার৷
সক্রেটিস গত হয়েছেন তেইশ শাে বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আজও তাকে মানুষের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক বলে গণ্য করা হয়৷ তার একটা বিখ্যাত পদ্ধতি ছিল, শ্রোতাদের তিনি কখনাে বলতেন না যে, তারা ভুল করেছেন৷ যে যাই বলুক, তিনি সমর্থন করতেন, সায় দিতেন৷ তারপর তিনি এমন মন্তব্য করতেন, এমন কিছু প্রশ্ন করতেন যার উত্তরে শ্রোতারা ‘ হ্যা ' উচ্চারণ করে জবাব দিত, কেননা তার প্রশ্ন এবং মন্তব্যগুলাে শ্রেতাদের স্বপক্ষে সমর্থনে তৈরি করতেন তিনি৷
আরো পড়ুনঃ- কেউ অপছন্দ করলে কী করবো
শ্রেতারা অধিকাংশ ছিল তার বিরুদ্ধ মতাবলখী, কিন্তু তবু, যেহেতু সক্রেটিস তাদের সমর্থন করে বা যা সত্য উল্লেখ করে তাদের মতামত চাইতেন, তারা ‘ হ্যা ' ছাড়া আর কিছু বলতে পারতেন না৷ এই পদ্ধতিতে তিনি বার বার, যত বেশি সম্ভব শ্রেতাদেরকে দিয়ে হা উচ্চারণ করিয়ে নিতেন৷ হা হা হ ” -এই একটা ইতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করতে প্রতিপক্ষ শ্রেতারা এমন এক সম্মােহনের পর্যায়েই পৌঁছে যে তারা এক সময় যে বিষয়ে চরম বিরােধীতা করেছিল, সেই বিষয়ে সক্রেটিসের সাথে একমত হয়ে ' হ্যা ' বলতে বাধ্য হতো৷
কৌশলটা একেবারেই সহজ৷ কার্যকরী কিনা, পরীক্ষা করে দেখলেই তাে পারেন৷ সক্রেটিসের বেলায় যে পদ্ধতি ফলপ্রসূ হয়েছে তা আপনার বেলায় না হবার কোন কারণ নেই৷ আজ থেকে গ্রহণ করুন নিয়মটাকে, দৈনন্দিন জীবনে যাকেই স্বমতে আনতে চান, তাকে প্রথমেই ‘হ্যা ” বলিয়ে নিন, যতাে বেশিবার সম্ভব৷ তাতে আপনি লাভবান হবেন৷
Thanks to comment Jibon Somossa official blog. Stay with us for more content. Follow us to Facebook. www.facebook.com/jibonsomossa.blog